রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:৩৫ পূর্বাহ্ন
আন্দালিব রাশদী:
কয়েকটি রসিক সংস্থার প্রতিনিধি কবরস্থানে গিয়ে সবিনয়ে কবরবাসীদের আহ্বান জানিয়েছেন তারা যেন সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং নিজ নিজ পরিবারের সদস্যকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে ভোটকেন্দ্রে না যান। জীবিত হোন কি মৃত, ভোটার লিস্টে নাম থাকলে সশরীরেই হোক কি গায়েবি পদ্ধতিতেই হোক পোলিং বুথে ঢু মারার বাধ্যবাধকতা কোনো কোনো দেশে থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। এই সুযোগ নিয়ে আলস্যবশত জীবিত ও প্রয়াত ভোটারদের কেউ কেউ শুয়েই থাকেন, ভরসা করেন কেউ না কেউ তো তার হয়ে পবিত্র আমানতটি কাজে লাগাবেন। প্রয়াত হলেও একসময় তো তাদের সবাই অস্তিত্ববান ছিলেন। জীবিতও নন, মৃতও নন এমন ভোটারের সন্ধানও রয়েছে। ২০১৪-তে এক বিস্তৃত অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্র এমন ৩১ জন অস্তিত্বহীন ভোটারের সন্ধান পেয়েছে। এলিয়েন ভোটার থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, এটা মেনে নিলেই হয়।
ভোট শেষ, ভোটার লিস্টের আর কী দরকার
ভোটার হওয়ার যোগ্যতা বাংলাদেশ এবং ব্রিটেনে একই। তফাৎ হচ্ছে ভোটার হলেও শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি ব্রিটিশ নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যায় না। ক্ষমতায় শ্রমিক দল না রক্ষণশীল দল এ খবরও অনেকেই রাখার প্রয়োজন মনে করে না। ওয়েলফেয়ার স্টেটে বিভিন্ন ধরনের কল্যাণ ভাতা ঠিক থাকলেই হলো। বেকার ভাতা, চাইল্ড বেনিফিট, ইনভ্যালিডিটি অ্যালাউন্স কিংবা ইনকাম সাপোর্ট বাড়লে খুশি, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেসের সেবা বাড়লে খুশি, ক্রিসমাসে টার্কির দাম কম হলে খুশি।
বাংলাদেশে ভোটার লিস্টে কোনোভাবে নাম ওঠাতে পারলে কোনো না কোনো দল ঠেলেঠুলে হলেও ভোটারকে কেন্দ্রে নিয়ে ছাড়বে; না গেলে যারাই ক্ষমতাবান থাকবেন তাদের কেউ না কেউ সন্তুষ্টচিত্তে তার ভোটটি দিয়ে দেবেন। ভোটার লিস্ট প্রণয়নে কিছু জালিয়াতি হয়েই থাকে। পুরুষকে মহিলা এবং মহিলাকে পুরুষ হিসেবে, শিশুকে বৃদ্ধ, বৃদ্ধকে শিশু হিসেবে হামেশাই দেখানো হয়। তারপরও তালিকায় নাম থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। পয়সাকড়ি দিয়ে একবার ভোটার তালিকায় নাম তুলতে পারলে মিয়ানমারের নাগরিককে অবৈধভাবে বাংলাদেশে চলাচল করার জন্য যখন পাসপোর্ট আইনে গ্রেপ্তার করা হবে, কোর্টে হাজির করা হবে; তখন অকাট্য প্রমাণ আসামি বাংলাদেশের নাগরিক, ভোটার তালিকায় নাম দেখুন। জেলে আটকে রাখে সাধ্য কার।
নির্দিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ভোটার তালিকা কেনা যায়। বাংলাদেশে এবং ব্রিটেনেও। দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৮৩২ সালেও ব্রিটেনে ভোটার লিস্ট বিক্রি হয়েছে। ১৯১৮ সালের পর থেকে নিয়মিত সর্বত্রই বেচাকেনা হচ্ছে। এই তালিকা স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে ছোট-বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোর কাজে লাগে, আদালতের কাজে লাগে। সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। ব্রিটেনে বছরে ৩০ বিলিয়ন পাউন্ড-স্টার্লিং মূল্যের বাণিজ্যের অন্যতম ভিত্তি এই ভোটার তালিকা।
এই তালিকা ধরেই বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো হানা দেয়, ক্যাটালগ পাঠায়, বিক্রেতা পাঠায় এবং তাদের পণ্য কিনতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু ভোটার লিস্ট প্রণয়নের যে উদ্দেশ্য তাতে বাণিজ্যিক সংস্থার উপকারের কথা কোথাও বলা নেই। ভোটার লিস্ট প্রকাশনা ও বিক্রির প্রক্রিয়াতে প্রচণ্ড আঘাত আনলেন ব্রায়ান রবার্টসন নামের ৫৮ বছর বয়সী একজন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাকাউন্টেন্ট।
প্রতিদিন যাতে বাজে চিঠিপত্র গ্রহণ না করতে হয় সে লক্ষ্যে পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের ওয়েকফিল্ড সিটি কাউন্সিলের এই বাসিন্দা ভোটার লিস্টে তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। কাউন্সিল ভোটার তালিকায় তার নাম রাখেনি। নাম ছাপা না হওয়ায় তিনি আর ভোটার থাকলেন না, ফলে সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেন না। এদিকে ভোটার হতে না পারা আইনত অপরাধ তবে ভোট না দেওয়া অপরাধ নয়। কাজেই তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়ে যায়। রবার্টসন জাঙ্ক মেইলের ভয়ে তালিকা থেকে নামটা কেটে দিতে বলেছেন, কিন্তু ভোটার হবেন না, নির্বাচনে ভোট দেবেন না এমন তো বলেননি।
রবার্টসন নিজেই অধিকার হরণের মামলা করলেন ইউরোপিয়ান কোর্টে। রবার্টসনের ভোট দিতে না পারাটা ইউরোপিয়ান কনভেনশন অফ হিউম্যান রাইটসের ৮ ধারায় প্রদত্ত অধিকার হরণের শামিল। বিচারক এজন্য সিটি কাউন্সিলকে দোষী সাব্যস্ত করেন, এবং ভোট দিতে না পারার ক্ষতিপূরণ রবার্টসনের প্রাপ্য বলে মনে করেন। অন্যদিকে সিটি কাউন্সিল ভোটার তালিকা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে ভোটারের ব্যক্তিগত নির্জনতা ও গোপনীয়তা নষ্ট করছে। এই তালিকার ওপর ভিত্তি করেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উৎপাত করে থাকে। রবার্টসন একা মানুষ, নির্জনতাই তার পছন্দ। ভোটার লিস্ট ধরে তার বাড়িতে জাঙ্ক মেইল আসুক, ফোন আসুক, কোম্পানির এজেন্ট আসুক কোনোটাই তার কাম্য নয়।
নব্বই ছুঁই ছুঁই মার্থা অভিযোগ করেছেন কৃত্রিম যৌনানন্দ লাভের জন্য ব্যবহৃত ভাইব্রেটর কিনতে তাকে উত্ত্যক্ত করছে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, তারা নিশ্চয়ই ভোটার লিস্ট থেকে তার ঠিকানা নিয়েছে।
বাণিজ্যিক সংস্থার কাছে ভোটার লিস্ট কোনোভাবেই তুলে দেওয়া যাবে না। এরপর যদি ভোটাররা একের পর এক বিরক্তির ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য মামলা করতে শুরু করে, কোনো কাউন্সিলই সবার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবে না। এতদিন মানুষ বিরক্ত হলেও মামলা তো করেনি। রবার্টসন মামলা করে জিতেছেন। বাণিজ্যিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে রুলিং জারি হয়েছে। এখন দেখা যাক, আগামীতে কী দাঁড়ায়।
ভোটার লিস্ট একটি পাবলিক ডকুমেন্ট-গণদাখিলা। এতে লুকোচুরির কী আছে? পয়সা দিয়ে লিস্ট না কিনেও তো কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো উপায়ে জোগাড় করতে পারে। সে ক্ষেত্রে কী হবে? নতুন রুলিং নিয়ে ভাবতে বসে গেছে অনেকেই।
ষাটের দশকের একটি নির্বাচন (দ্য টাইমস, ২৮ নভেম্বর ১৯৬৪)
রাওয়ালপিন্ডি থেকে ২৭ নভেম্বর ১৯৬৪ লন্ডন টাইমস প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদের সারসংক্ষেপ: পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে সাতজন আবেদনকারীকেই বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই সাত জন হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ শোয়াইব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো, যোগাযোগমন্ত্রী আবদুল সবুর খান, মিস ফাতিমা জিন্নাহ এবং দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী কে এম কামাল এবং মিয়া বশির। বিরোধী দল রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ করেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সক্রিয় সদস্যের তালিকায় এখনো আইয়ুব খানের নাম রয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নন। রিটার্নিং অফিসার সংক্ষিপ্ত শুনানি শেষে আইয়ুব খানেক নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুপযুক্ত ঘোষণার আবেদনটি নাকচ করে দিলেন।
রিটার্নিং অফিসার জানালেন তার কাছে যে কাগজপত্র আছে তাতে এই প্রার্থীকে অবসরপ্রাপ্ত দেখানো হয়েছে। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিরোধীদের আইনজাবী মুহাম্মদ আনোয়ার যুক্তি দেখান যে ১৯৬০ সালের জুলাই মাসের প্রজ্ঞাপনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে সেনাবাহিনীর অর্ধ বেতনে কর্মরত দেখানো হয়েছে এতে অবসরের কথা উল্লেখ করা হয়নি। তিনি বলেন, একজন ফিল্ড মার্শাল কখনো অবসর গ্রহণ করেন না। যে কোনো সময় তাকে সক্রিয় সৈনিক জীবনে ডাকা হতে পারে। তিনি তার বক্তব্যের সমর্থনে ব্রিটিশ উদাহরণ তুলে ধরে বলেন যিনি একবার ফিল্ড মার্শাল হন, তিনি সারা জীবনের জন্যই ফিল্ড মার্শাল।
প্রেসিডেন্টের পক্ষে অ্যাটর্নি মঞ্জুর কাদির বলেন, প্রেসিডেন্টের নাম সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্তদের তালিকায় দেখানো হয়েছে আর ব্রিটেনে কেবল সশস্ত্র বাহিনীর নিয়মিত সদস্যরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না, তবে জরুরি ও বিশেষ কমিশন্ডপ্রাপ্ত সৈনিক এবং সংরক্ষিত তালিকায় থাকায় সৈনিক নির্বাচন করতে পারেন।
(১৯৬১’র আদম শুমারিতে পবিস্তানের জনসংখ্যা ৯ কোটি ৩০ লাখ, এর মধ্যে ৫ কোটিই পূর্ব পাকিস্তানের। ১৯৬৫’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটার লিস্টে ভোটারের সংখ্যা ৮০ হাজার, ৪০ হাজার পূর্ব পাকিস্তানে, ৪০ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৫৯ সালে উদ্ভাবিত পাকিস্তান বেসিক ডেমোক্রেসি আইনে ৮০ হাজার গণপ্রতিনিধি বেসিক ডেমোক্রেসি নামক ক্যারিকেচারের চেয়ারম্যান আইয়ুব খানকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন।)
আইয়ুব খানের দল মানে কনভেনশন মুসলিম লিগ আর বিরোধী দল মানে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিস, এতে শেষ পর্যন্ত মওলানা মওদুদির নেতৃত্বাধীন জামায়াত ই ইসলামীও যোগ দেয়। শুরুতে তারা নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা ছিলেন।
রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলে সেখানেও আবেদন নাকচ হয়ে যায়।
মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকাই বলে দেয় এর একটি বড় অংশ আইয়ুব খানের পাতানো খেলার খেলুড়ে। আইয়ুব খানের তিনজন মন্ত্রী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। কে এম কামাল ও মিয়া বশিরকে সম্ভবত পয়সাকড়ি দিয়ে সরকার পক্ষ থেকেই দাঁড় করানো হয়েছিল। প্রকৃত বিরোধী প্রার্থী একজনই ‘কায়েদে আজম’ মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ।
মৌলিক গণতন্ত্রী ৮০ হাজার চেয়ারম্যানের সমম্বয়ে গঠিত ইলেক্টোরাল কলেজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। আইয়ুব খানের পক্ষে ভোটার কেনাকাটার কাজও চালানো হয়। ৫১২০০ ভোটার (মোট ভোটারের ৬৪ ভাগ) নির্বাচনে ভোট দেন। প্রদত্ত ভোটের ৬৪ ভাগ পান আইয়ুব খান। ২ জানুয়ারি ১৯৬৫’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আইয়ুব খানের ক্ষমতা আরও সংহত করে।
১৯৬৫’র নির্বাচনে কয়েকটি এলাকার ভোটের প্যাটার্ন লক্ষণীয় :
স্থান প্রদত্ত ভোট আইয়ুব ফাতিমা অন্যান্য বাতিল ভোট
করাচি ১৯০৩ ৮৩৭ ১০৪৯ ৪ ১৩
লাহোর ১২০৮ ৮১৯ ২০১ ১ ১৭
রাওয়ালপিন্ডি ৩৯৭ ২০২ ১০৬ ২ ৮
পেশোয়ার ৩২০ ২৯৯ ২১৫ ০ ৬
ঢাকা ৫৫৫ ১৯৯ ৩৫৩ ১ ২
চট্টগ্রাম ৩৩৪ ১৮১ ১৫১ ০ ২
খুলনা ২৮২ ১৬৭ ১৯৩ ২ ০
কুমিল্লা ২৮৬ ১৫৬ ১২৮ ০ ২
এই ভোটার লিস্টে যাদের নাম ছিল তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে রাজাকারের তালিকায় নাম ওঠাতে সক্ষম হলেও কায়দা করে মুক্তিযোদ্ধার সনদও জোগাড় করে রেখেছিলেন। কখন কোনটা কাজে লাগে কে জানে!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
ভয়েস/আআ